Brahmanbaria ০১:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Last News :
কসবায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মা ও ছেলের মৃত্যু! নবীনগরে  ভ্রাম্যমান আদালতের  অভিযান তিন শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ তরী বাংলাদেশ বিজয়নগর উপজেলা আহবায়ক কমিটি গঠন। বিজয়নগরে বাবার বিরুদ্ধে ৯ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির ১৮ জন সদস্যকে সংবর্ধণা প্রদান  সালিশে অভিযোগে নারীকে নির্যাতন,বর্তমান ও সাবেক ইউপি সদস্য আটক! নাসিরনগরে যৌন নিপিড়ন মামলার আসামি বাঁচাতে প্রধান শিক্ষকের কৌশল স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রেতাত্মারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত: আইনমন্ত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৯ মামলার পলাতক আসামি গ্রেফতার! ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের বাৎসরিক কর্ম মূল্যায়ন ও সংবর্ধনা

রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’র মহাপ্রস্থান : অতল শ্রদ্ধা

  • Reporter Name
  • Update Time : ০২:০৯:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ জুন ২০২৩
  • ৮৯৮ Time View
        🔳 এইচ.এম. সিরাজ 🔳
বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান (দাদা ভাই) আর বেঁচে নেই। ০৯ জুন’২৩ শুক্রবার  দুপুর সোয়া ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন, ইন্নালিল্লাহি —– রাজিউন। সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারি মো. রাসেল বলেন, শুক্রবার দুপুর সোয়া দুইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরাতন ভবনের চতুর্থ তলার আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত ৮৩ বছর (১৯৪১-২০২৩) বয়েসী সিরাজুল আলম খানের দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ছাত্র-যুব নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এক বিষ্ময়কর ব্যাপার। এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী সিরাজুল আলম খানের স্মৃতির প্রতি জ্ঞাপন করছি অতল শ্রদ্ধা।
সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার আলীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। স্থানীয় স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করে চলে যান বাবার কর্মস্থল খুলনায়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে খুলনা জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং ১৯৫৮ খ্রি. ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর ‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণ করার কারণে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়।প্রতিদিন রাত করে বিশ্ববিদ্যায়ের হলে ফিরতেন। ফলে হল থেকেও একবার বহিষ্কৃত হন সিরাজুল আলম খান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় তাঁর পক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়া সম্ভব হয়নি।
ষাটের দশকে রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের উত্থান। এ সময় আরও কয়েকজন ছাত্রনেতা রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের এক জায়গায় বেশ ফারাক। সেটি হচ্ছে, তিনি ধারাবাহিকভাবে লেগে ছিলেন। সিরাজুল আলম খান ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রলীগের সহ সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে বাংলাদেশীদের স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’র তিনিই ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। এই নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এই ছাত্র নেতারা। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল আলম খান। তিনি নিজেই বলেছেন, শেখ মুজিবের ছয় দফা তাঁর বুকের মধ্যে আগুন জ্বেলে দিয়েছিলো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ঊনসত্তরে শেখ মুজিব যখন জেল থেকে ছাড়া পান, তখন দেখলেন, তাঁর জন্য জমি তৈরি হয়ে আছে; যার উপর ভরসা করে বীজ বোনা যায়। শেখ মুজিবকে নেতা মেনেই জমি তৈরির এই কাজটি করেছিলেন সিরাজুল আলম খান।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানকে ‘রহস্য পুরুষ’ আখ্যা দেওয়া হয়। ‘দাদাভাই’ নামেও তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত। সিরাজুল আলম খানের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য’ থেকে জানা যায়, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে তিনি এবং তাঁর গড়ে তোলা ‘নিউক্লিয়াস’ ভূমিকা রেখেছিল। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজনও ছিলেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার পর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। গড়ে ওঠে একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ১৯৭৫’র ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘অভ্যুত্থান’ বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে এক ঘটনা। জাসদ গঠন এবং ‘অভ্যুত্থান’র নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর এই দুটি বৃহৎ ঘটনার নায়ক ছিলেন মেজর জলিল, আ.স.ম আবদুর রব এবং লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আবু তাহের।
সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় সাত বছর কারাভোগ করেন। কনভোকেশন মুভমেন্টের কারণে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে জিয়ার আমলে আবার গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্মে মুক্তি পান। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মার্চ বিদেশ যাবার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে সিরাজুল আলম খানকে গ্রেপ্তার করা হলে চার মাস পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান।
সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেল জীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান,অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সঙ্গীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে ওঠে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি ১৯৯৬-৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের ওশকোশ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণে সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়। তাঁর দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ছাত্র-যুব নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এক বিষ্ময়কর ব্যাপার। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “সিরাজুল আলম খান ষাটের দশকের সফল সংগঠন ছিলেন। তিনি আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ক্ষমতার সঙ্গে শামিল হননি। ক্ষমতায় থাকলে তাঁর বিত্ত বৈভব হতে পারতো। তিনি তা করেন নি। তিনি তরুণদের সংগঠিত করেছিলেন।”
Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় খবর

কসবায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মা ও ছেলের মৃত্যু!

রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’র মহাপ্রস্থান : অতল শ্রদ্ধা

Update Time : ০২:০৯:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ জুন ২০২৩
        🔳 এইচ.এম. সিরাজ 🔳
বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান (দাদা ভাই) আর বেঁচে নেই। ০৯ জুন’২৩ শুক্রবার  দুপুর সোয়া ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন, ইন্নালিল্লাহি —– রাজিউন। সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারি মো. রাসেল বলেন, শুক্রবার দুপুর সোয়া দুইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরাতন ভবনের চতুর্থ তলার আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত ৮৩ বছর (১৯৪১-২০২৩) বয়েসী সিরাজুল আলম খানের দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ছাত্র-যুব নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এক বিষ্ময়কর ব্যাপার। এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী সিরাজুল আলম খানের স্মৃতির প্রতি জ্ঞাপন করছি অতল শ্রদ্ধা।
সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার আলীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। স্থানীয় স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করে চলে যান বাবার কর্মস্থল খুলনায়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে খুলনা জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং ১৯৫৮ খ্রি. ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর ‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণ করার কারণে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়।প্রতিদিন রাত করে বিশ্ববিদ্যায়ের হলে ফিরতেন। ফলে হল থেকেও একবার বহিষ্কৃত হন সিরাজুল আলম খান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় তাঁর পক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়া সম্ভব হয়নি।
ষাটের দশকে রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের উত্থান। এ সময় আরও কয়েকজন ছাত্রনেতা রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের এক জায়গায় বেশ ফারাক। সেটি হচ্ছে, তিনি ধারাবাহিকভাবে লেগে ছিলেন। সিরাজুল আলম খান ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রলীগের সহ সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে বাংলাদেশীদের স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’র তিনিই ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। এই নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এই ছাত্র নেতারা। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল আলম খান। তিনি নিজেই বলেছেন, শেখ মুজিবের ছয় দফা তাঁর বুকের মধ্যে আগুন জ্বেলে দিয়েছিলো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ঊনসত্তরে শেখ মুজিব যখন জেল থেকে ছাড়া পান, তখন দেখলেন, তাঁর জন্য জমি তৈরি হয়ে আছে; যার উপর ভরসা করে বীজ বোনা যায়। শেখ মুজিবকে নেতা মেনেই জমি তৈরির এই কাজটি করেছিলেন সিরাজুল আলম খান।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানকে ‘রহস্য পুরুষ’ আখ্যা দেওয়া হয়। ‘দাদাভাই’ নামেও তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত। সিরাজুল আলম খানের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য’ থেকে জানা যায়, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে তিনি এবং তাঁর গড়ে তোলা ‘নিউক্লিয়াস’ ভূমিকা রেখেছিল। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজনও ছিলেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার পর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। গড়ে ওঠে একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ১৯৭৫’র ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘অভ্যুত্থান’ বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে এক ঘটনা। জাসদ গঠন এবং ‘অভ্যুত্থান’র নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর এই দুটি বৃহৎ ঘটনার নায়ক ছিলেন মেজর জলিল, আ.স.ম আবদুর রব এবং লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আবু তাহের।
সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় সাত বছর কারাভোগ করেন। কনভোকেশন মুভমেন্টের কারণে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে জিয়ার আমলে আবার গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্মে মুক্তি পান। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মার্চ বিদেশ যাবার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে সিরাজুল আলম খানকে গ্রেপ্তার করা হলে চার মাস পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান।
সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেল জীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান,অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সঙ্গীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে ওঠে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি ১৯৯৬-৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের ওশকোশ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণে সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়। তাঁর দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ছাত্র-যুব নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এক বিষ্ময়কর ব্যাপার। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “সিরাজুল আলম খান ষাটের দশকের সফল সংগঠন ছিলেন। তিনি আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ক্ষমতার সঙ্গে শামিল হননি। ক্ষমতায় থাকলে তাঁর বিত্ত বৈভব হতে পারতো। তিনি তা করেন নি। তিনি তরুণদের সংগঠিত করেছিলেন।”