আজ ১৩জুন, ৩০ জ্যৈষ্ঠ। ডকুমেন্ট স্বীকৃতি দিচ্ছে আজ আমার জীবনের স্মরণীয় দিন। অর্থাৎ আজকে আমার জন্মদিন। যেহেতু ডকুমেন্টই বলছে, তাহলে ফেসবুক? সে তো বলবেই। কেননা, এখানে আইডি খুলে অন্তর্ভূক্তকালেই জন্মতারিখের অপশনটা স্বেচ্ছায়ই পূরণ করেছিলেম। সেহেতু এই ভার্চুয়াল জগতের সকলের কাছে আজকেই আমার জন্মদিন। এই অভাজনের অবস্থানুপাতে ইতোমধ্যে অসংখ্যজন বিভিন্নভাবে জন্মদিনের শুভ কামনা জানিয়ে করেছেন সিক্ত-কৃতার্থ-আপ্লুত। আপনাদের সকলের প্রতিই হৃদয়ের আখর থেকে জ্ঞাপন করছি গভীর কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা। তবে বিশেষত ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে অনেকটা বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কারণ, এই মাধ্যমটির বদান্যতাতেই তো বিষয়টি এতো ওপেনসিক্রেট।
আমি জন্মেছি এক অজপাড়াগাঁয়ে, এক সেকেল মায়ের ঘরে। সন্তানের জন্মতারিখটা লিখে রাখতে হবে, এমনটা আদৌ জানতেন না আমার গর্ভধারিণী মা। আর তেমন সক্ষমতাটুকুও তো ওনার ছিলো না। তাছাড়া এসবের দরকারই-বা কী? যদিও আজকের বাস্তবতায় সম্পূর্ণটাই ভিন্ন। বর্তমান জামানায় জন্ম সনদ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা নিতান্ত বাধ্যতামূলকও বটে। এখন ডিজিটাল যুগ, গোটা বিশ্বটাই তো এখন গ্লোবাল ভিলেজ। আমরাও ব্যববহার শুরু করেছি স্মার্টকার্ডের। সে যাকগে, পরবর্তী সময়ে আমার মা বিষয়টা নিশ্চিত করেছেন যে, মধুমাস জ্যৈষ্ঠ-এ আমার জন্ম। মায়ের ভাষ্যটা ছিলো ঠিক এমন, ‘জেষ্টে মাসের আট/নয়দিন থাকতে তুমি অইছত।’ অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাসের ২১-২৩ তারিখে আমার জন্ম। সে হিসেবে খ্রিষ্টীয় সনের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়েই হবে।
—
প্রাইমারি শিক্ষার পুরো পাঠ চুকাতে জন্মতারিখের খুব একটা প্রয়োজন পড়েনি। হয়তোবা প্রয়োজন ছিলোও, শিক্ষক মহোদয়রা নিজেরাই সেরে নিয়েছেন; আমায় কদ্যপি বুঝতেও দেননি। মাধ্যমিকের শেষার্ধে, নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নের সময়েই করতে হতো রেজিস্ট্রেশন। এটাই হতো শিক্ষাবোর্ডে প্রেরিত সর্বপ্রথম ডকুমেন্ট। সঙ্গতেই এখানে এসে আমি আর রেহাই পেলাম না। এবার তো আমাকে আমার জন্মতারিখটা লিখতে হবেই। কেননা, জীবনে প্রথমবারের মতো গেজেটভূক্ত হওয়া। আর এটাতো বাধ্যতামূলকও বটে। কেননা, এই রেজিস্ট্রেশনের তথ্য অনুযায়ীই তো পরবর্তীতে হবে ফরমফিলাপ, হবো এসএসসি পরীক্ষায় তালিকাভূক্ত। পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রবেশপত্র, উত্তীর্ণ হওয়ার পর নম্বরফর্দ, সনদপত্র সকলকিছু তো এটাতেই নির্ভরশীল। কাজেই এখানে কোনরকম নয়-ছয় করলে তো সারাটা জীবনই পস্তাতে হবে।
যথানিয়মেই রেজিস্ট্রেশন ফরমে সকল তথ্য-উপাত্তই উপস্থাপন করলাম। এবার এলো জন্মতারিখ লিপিবদ্ধ করার পালা। আটকে যেতেই হলো। কেননা, এটা যে আমার জানা নেই! এখন কী করি? আচমকাই মাথায় একটা বুদ্ধি খেললো। যেহেতু নির্ধারিত কোনো একটি জন্মতারিখ আমার জানাই নেই, সেহেতু এমন একটা তারিখই লিপিবদ্ধ করবো, যেনো এটা হয় সম্পূর্ণভাবেই একটু ব্যাতিক্রম। আবার অতি সহজেই তারিখটাকে মনেও রাখা যায়। আর এক্ষেত্রে প্রথমেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাব স্বীকৃত দিবসগুলোকে বাদ দিলাম। অবশেষে নির্ধারণ করলাম ‘১৯৭৫ সালের ১৩ জুন’। আমার মায়ের দেয়া তথ্যের সাথে কেবলমাত্র মাসের নামটাই মিল আছে, সন-তারিখে কোনোই মিল নেই!
‘লাকী সেভেন’ আর ‘আনলাকী থার্টিন’ এই শব্দগুলোর সাথে ছোট্টকাল থেকেই ছিলো বেশ পরিচয়। এসবের দালিলিক প্রমাণ যাই হোক না কেন, লোকে প্রবাদসমই মানে। অবশ্য এই ‘লাকী সেভেন’ এবং ‘আনলাকী থার্টিন’ এর আবিস্কারক খ্রিস্ট সম্প্রদায়। এসবের পেছনেও রয়েছে করুণ এক ইতিহাস। সেদিকে আজকে নাহয় আর নাই-বা গেলাম। প্রচলিত ভাষায় আনলাকী থার্টিন’র বাংলা রূপও আছে বৈকি। ‘তেরো মানে ফের’ অর্থাৎ বিপজ্জনক। অথচ এই আনলাকী থার্টিনকেই আমি স্বেচ্ছায় নিজের জন্মদিন বানালাম! তার কারণ এটাই যে, যেহেতু আমিই আমার জন্মদিন জানতাম না, আমার এটাইতো দুর্ভাগ্য; তাই তারিখটাও হওয়া চাই এমনই। আর এভাবেই আনলাকী থার্টিন অর্থাৎ ১৩ জুন তারিখটিই হয়ে গেলো আমার কাগুজে অর্থাৎ সনদপত্র মোতাবেক জন্মদিন।
যেহেতু নিজের জন্মতারিখই আমার অজানা, সেহেতু জন্মকাল/শিশুকালের কোনো ছবি থাকা তো নিতান্ত অকল্পনীয়ই। নিম্নে সংযোজনকৃত চেক শার্ট পরিহিত ছবিটা এক হিসেবে অনেকটা আমার শিশুকালেরই। এটি সেই ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে কলেজে ভর্তিকালের। এটাই আমার জীবনের দ্বিতীয় ছবি। যদিও এটা আমার সংগ্রহে নাই। আর মায়ের সাথের একান্ত মুহূর্তের এই ছবিটা বিগত ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের অনেকটাই গোড়ার দিকে প্রয়াত বড় খালার বাড়িতে মোবাইল ফোনে ধারণকৃত, এবং এটাই আমার মুসাফির জীবনের সর্বসেরা ছবি। তৃতীয় স্থানে বাবার ছবিটা আমার জন্মেরও বহু আগেকার, যখন তিনি সরকারি ডিলার ছিলেন। মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে গ্রামকে ছেড়ে শহরে আগমণকালে স্মৃতি হিসেবে আনা বাবার এই ছবিটার সাথে বাঁধাই করে রাখাতেই হয়তো কলেজে ভর্তিকালে আমার ছবির ফসীলটা অন্তত রয়ে গেছে! আর সর্বশেষ ছবিটা পেশাগত জীবনে পিআইবি মিলনায়তনে (২০১৮ খ্রি.) প্রশিক্ষণ গ্রহণান্তে তদানীন্তন পিআইবি’র মহাপরিচালক মো. শাহ্ আলমগীরের কাছ থেকে সনদপত্র গ্রহণের মাহেন্দ্রক্ষণের স্মৃতি স্মারক।