চারদিকেই এখন পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ পালন করার ঘনঘটা। নেহায়েতই ‘উৎসব’ পালন করার মওকাতেই যেনো আজকাল আমরা মহাব্যস্ত। কিন্ত এই ‘বাংলা নববর্ষ’ আমরা পেলাম ঠিক কখন থেকে? মোদ্দাকথা এটির প্রচলন হয় কখন? সেই ইতিহাস কি আমরা জানি? জানতে কি চাই? এর প্রবর্তক কে? তাদের কি আমরা কদ্যপিও স্মরণ করি? করতেও কি চাই?
*বাংলা সন সর্বপ্রথম প্রবর্তিত হয় ভারতবর্ষে। বাংলা সনের প্রবর্তন করেন ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর, এর বিনির্মাতা চিন্তক হলেন ফতেহ্ উল্লাহ সিরাজী।আবার কেউ বলেন বাংলা সনের প্রবর্তক গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক। সত্যিকারার্থে,বঙ্গাব্দের প্রবর্তক রাজা শশাঙ্ক না সম্রাট আকবর নাকি অন্য কেউ; এই দ্বিধান্বিতা থাকাটি উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। তবে এটাও সত্য যে, বঙ্গাব্দে অন্তর্ভূক্ত মাসসমূহের নাম দেখে মনে হয় এগুলো অনেক পুরানো। শুধু আকবর নয়, শশাঙ্কেরও বহু পূর্বে প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও শিলালিপিতে পাওয়া যায়। তাই বাংলা সনের প্রবর্তন নিয়ে মতান্তর থাকলেও সম্রাট আকবর প্রবর্তিতের বিষয়টি বাস্তবতার নিরীখে সর্বজন স্বীকৃত।
*মহামতি আকবর। আকবর দ্যা গ্রেট। যে নামেই ডাকা হোক, তিনি হলেন মোঘল বংশের সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। এই সম্রাট আকবর ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট। ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘল সাম্রাজ্য তথা মোঘল বংশের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ওরফে বাদশাহ্ বাবর এর দৌহিত্র হলেন সম্রাট আকবর। অপরদিকে তিনি মোঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট হুমায়ুন’র পুত্র। আর এই আকবরের শাসনামলেই ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ থেকে বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু হয়। শুরু থেকে ম্যালা সময় অবধি বাংলা নববর্ষ তার নিজস্ব ঢঙ অনুযায়ী-ই পালিত হতো। কালের বিবর্তনে এতে ঘটে নানান কিছিমের সংযোজন-বিয়োজন, সময়ের পরিক্রমায় হারায় তার নিজস্বতা।
*প্রজা সাধারণের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার সুবিধার্থেই (প্রজাদের দাবী সমন্বিত রেখে) সম্রাট আকবরের একান্ত ইচ্ছাতে তৎকালীন বাংলার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তক ফতেহ্ উল্লাহ সিরাজী বাংলা সনের নিয়মানুবর্তিতা তৈরি করেন। প্রজা সাধারণকে খাজনাদি প্রদানে উৎসাহ যুগাতে নিয়মানুবর্তিতায় কিছু আচার সংযোজন করা হয়, যাতে মানুষ এটাকে একরকম উৎসবানন্দও বোধ করেন। নতুন করে প্রবর্তিত বাংলা সনে ‘সৌরবর্ষ’ বা খ্রিষ্টীয় সন ও ‘চান্দ্রবর্ষ’ বা আরবি কিংবা হিজরি সনের উপর ভিত্তি করা হয়। তাছাড়া সম্রাট আকবরের মসনদে আরোহণকাল চান্দ্র সন ৯৬৩ হিজরিকে সৌর গণনায় আনা হয়। সৌর ও চান্দ্র এই দু’টি সনের উপর নির্ভর করেই প্রবর্তন করা হয় বাংলা সন। সৌর কেন্দ্রিক ছিলো বলেই সপ্তাহের বারের নামগুলোকেও রাখা হয় সৌর বলয়ের সঙ্গে মিলিয়ে। যেমন- মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি ইত্যাদি।
*মূলত সৌর পঞ্জিকা কেন্দ্রিক কৃষকের উৎপাদিত ফসলের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চৈত্র মাসের ৩০ তারিখে বকেয়া খাজনা পরিশোধ করবার দিন (কৃষকদের দাবীর সাথে সমন্বয় রেখে) ধার্য্য করার লক্ষ্যেই বাংলা নববর্ষের প্রবর্তন করা হয়। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার কৃষকবৃন্দ দিল্লী রাজ দরবারকে জানিয়ে দেন- অগ্রহায়ণে আমন ধান দিয়ে খাজনা আদায়ের বদলে বৈশাখের ধান দিয়ে খাজনা আদায় করাটাই তাদের জন্য সুবিধার বলে দাবী জানায়। তাদের সেই দাবীকে গুরুত্ব দিয়েই যেসব কৃষকেরা চৈত্র মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে বাৎসরিক বকেয়া খাজনাদি পরিশোধ করতে সক্ষম হতেন, পরদিন তাদেরকেই অত্যন্ত সাদরে আপ্যায়ণও করা হতো। এই দিনটিই হচ্ছে পহেলা বৈশাখের উৎসব। আগের বছরের খাজনাদি আদায় করতে সক্ষম হওয়া কৃষকদেরকে পয়লা বৈশাখের এই দিনটিতে তথা নববর্ষের দিনে মিষ্টান্ন পরিবেশন করানোর মাধ্যমে করা হতো আপ্যায়ন। আর সেই আনন্দায়োজনের সাথে সাথেই পরবর্তী আরো এক বছরের জন্য সেইসব কৃষকদের মাঝে নতূন করে দেয়া হতো জমির বন্দোবস্ত।
*সময়ের সাথে পাল্লা দিয়েই এগুতে থাকে বিশ্ব। আর এরই ধারাবাহিকতায় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় মানুষের জীবনধারায় পরিবর্তন যেনো এক চলমান প্রক্রিয়া। আর এই প্রক্রিয়া কদ্যপিও থেমে নেই, কেবলই গতিশীল। ঠিক তেমনি গতিধারায় কৃষিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থাতেও ক্রমশই বিকাশ ঘটতে থাকে শিল্পের। প্রসার ঘটে ব্যবসা-বাণিজ্যের। কৃষি কাজের পাশাপাশি ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে থাকেন বাঙালিরা। কিন্তু তাই বলেই বাঙালি তার নিজের ঐতিহ্যকে ছাড়েনি কিছুতেই। চৈত্র মাসের শেষের দিনটিতে যেমনিভাবে কৃষকদেরকে সারা বছরের বকেয়া খাজনা আদায় করতে হতো, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বজায় রাখেন তদ্রুপ এক ধারবাহিকতা। সারা বছরের বকেয়া আদায়ের কৌশলগত আরেকটি উপায়ও বের করেন। এই ক্ষেত্রে বকেয়াদারদের সম্মানে নিমন্ত্রণপত্রের মাধ্যমে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নিমন্ত্রিতদেরকে পরিবেশন করানো হয় মিষ্টান্ন। এই আনন্দায়োজনে সামিল হতে তারাও বকেয়া মিটিয়ে ফেলতে হন উদ্বুদ্ধ। একেই বলা হয় ‘হালখাতা’ উৎসব।
*বাংলা সনকে ফসলি সনও বলা হয়ে থাকে। আর এই বাংলা সনের আসল স্রষ্টা হলেন আবহমান বাংলার কৃষক সমাজ। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার কৃষকবৃন্দ দিল্লী রাজ দরবারকে জানিয়ে দেন- অগ্রহায়ণে আমন ধান দিয়ে খাজনা আদায় সম্ভব নয়। কৃষক পরিবার এবং জনগণ নবান্ন উৎসব নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তাছাড়াও থাকে নানাবিধ সমস্যা থাকে। তাই বৈশাখের ধান দিয়ে খাজনা আদায় করাটাই তাদের জন্য সুবিধার বলে দাবী জানায়। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সন চালু হবার তিন বছর আগে পূর্ববঙ্গের ত্রিপুরা রাজ্যে ‘ত্রিপুরাব্দ’ চালু হয়। তাছাড়া বিভিন্ন পরগনাগুলোর কোথাও কোথাও ‘পরগনাতি সন’ চালু হয়। এসব সমস্যা মোকাবিলা করতেই বাদশাহ্ জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতি বিবেচনা করে মূলত কৃষকদের আবেদন বিবেচনা করে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ তারিখে নতুন বাংলা সন তথা ফসলি সন চালু করেন।
*এখন বিশ্বায়নের যুগ। সেই রাজা-জমিদার আজ আর নাই, তাদের জমিদারিও নাই; ঘটা করে খাজনা পরিশোধ করার ঝামেলাও নাই। আবার সেই ব্যবসা-বাণিজ্যের হালখাতা অনুষ্ঠানও আজকাল অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। তথাপিও থেকে গেছে বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি বাংলা নববর্ষ গণনা, বর্ষবরণের উৎসব। বাংলা সন সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে প্রবর্তিত হয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কেউ বলেন তা প্রবর্তন করেন মোঘল সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর,আবার কেউ বলেন গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক। সত্যিকারার্থে, বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা শশাঙ্ক না আকবর নাকি অন্য কেউ; এই দ্বিধান্বিতা থাকলেও বাংলা সন বাঙালির ঐতিহ্য। এক কালের খাজনা পরিশোধ করার দিন- পরবর্তী কালের হালখাতা অনুষ্ঠান ঘিরেই আজ রূপ নিয়েছে অসম্প্রাদায়িক বাঙালিদের প্রাণের আনন্দ উৎসবে। একজন বাঙালি হিসেবে আমিও এই উৎসবের অংশীদার বটি। তাই সঙ্গত কারণেই সকলকে জানাই বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন।
* এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : serajhm@gmail.com